বিডিনিউজ ১০ ডটকম ডেস্ক: মিয়ানমারে সহায়ক পরিবেশ তৈরি না হওয়া পর্যন্ত রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন না করার পক্ষে মত দিয়েছেন কূটনীতিকরা।
কূটনীতিকদের মতে, মিয়ানমারে এখনও সহায়ক পরিবেশ তৈরি হয়নি। এ অবস্থায় রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন মোটেই নিরাপদ নয়। শুধু যারা প্রত্যাবাসনে ইচ্ছুক, তাদের মিয়ানমারে ফেরত পাঠানোর পক্ষে মত দিয়েছেন তারা।
মিয়ানমারের পরিস্থিতির উন্নয়নের বিষয়ে রোহিঙ্গাদের মধ্যে আস্থা ফিরিয়ে আনতে জনগোষ্ঠীটির দলনেতাদের জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে মিয়ানমারের পরিস্থিতি পরিদর্শনের প্রস্তাব দিয়েছে জাপান। পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলীর কূটনৈতিক ব্রিফিংয়ে ঢাকাস্থ কূটনীতিকরা এ তথ্য জানিয়েছেন।
রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় বৃহস্পতিবার বিকালে বৈঠক শেষে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে কূটনীতিকদের উদ্দেশে ব্রিফিংয়ের আয়োজন করে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। ব্রিফিংয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী, পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব এবং সচিবরা ছাড়াও অন্য কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। এছাড়া ঢাকাস্থ বিভিন্ন মিশনের প্রধান, প্রতিনিধি রাষ্ট্রদূত, হাইকমিশনার এবং কূটনীতিকরা কূটনৈতিক ব্রিফিংয়ে অংশ নেন।
বৈঠক সূত্র জানায়, কূটনীতিকদের ব্রিফিংটি মূলত রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন নিয়েই ছিল। বৈঠকে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে এখন পর্যন্ত সরকারের নেয়া বিভিন্ন পদক্ষেপ এবং পরিস্থিতি কূটনীতিকদের সামনে বিস্তারিত তুলে ধরা হয়। এছাড়া পররাষ্ট্রমন্ত্রী কূটনীতিকদের বাংলাদেশের আসন্ন জাতীয় নির্বাচনের বিষয়ে ব্রিফ করেন।
এ সময় একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন অনুষ্ঠানে বর্তমান ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকারের নেয়া পদক্ষেপগুলো তুলে ধরা হয়। এ সময় বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সংলাপের বিষয়টিও বৈঠকে তুলে ধরা হয়। সংলাপ বিষয়ে কূটনীতিকদের বিস্তারিত জানান পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী।
বৈঠক শেষে ঢাকাস্থ ভারতীয় হাইকমিশনার হর্ষবর্ধন শ্রিংলা বলেন, বৈঠকে ভারতের পক্ষ থেকে নিরাপদ, দ্রুত ও টেকসই প্রত্যাবাসনের কথা বলা হয়েছে। সঠিক উপায়ে প্রত্যাবাসনে বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে কাজ করবে ভারত।
এ উদ্দেশে রাখাইন রাজ্যে আমরা ঘরও তৈরি করেছি। এছাড়া রোহিঙ্গাদের উদ্দেশে তিনবার আমাদের রিলিফ পণ্য এসেছে। আসন্ন শীতকে কেন্দ্র করে আমরা কম্বল, গরম কাপড়, সোলার প্যানেলসহ অন্যান্য সামগ্রী রিলিফ হিসেবে দেব। পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশ রোহিঙ্গাদের জোর করে পাঠাচ্ছে না।
এটি একটি ক্যাম্পেইন ছড়ানো হচ্ছে। ভারত ও চীন মংডুতে ঘরবাড়ি তৈরি করছে। সেখানে বাচ্চাদের স্কুল, হেলথ সেন্টার, ক্লিনিকও তৈরির কাজ এগিয়ে চলছে। জাতিসংঘ মহাসচিবের সঙ্গে বৈঠকের প্রসঙ্গ টেনে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, সেপ্টেম্বরের শেষে নিউইয়র্কে জাতিসংঘের মহাসচিব বৈঠক করেছিলেন।
সেখানে চীন, মিয়ানমারের পররাষ্ট্রমন্ত্রীও ছিলেন। সেখানে জাতিসংঘের মহাসচিব বলেছিলেন, বেশিদিন থাকলে এরা মারাত্মক ঝুঁকির মধ্যে চলে আসবে। এখানে সন্ত্রাসী কার্যক্রম ঘটাতে পারে তারা।
ঢাকাস্থ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলে, যুক্তরাষ্ট্র ১৫ নভেম্বর থেকে হাজার দুয়েক রোহিঙ্গা শরণার্থীর প্রত্যাবাসন শুরুর বিষয়ে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের যৌথ পরিকল্পনার ওপর ঘনিষ্ঠভাবে নজর রাখছে। যুক্তরাষ্ট্র ইউএনএইচসিআর’র মূল্যায়নের সঙ্গে একমত, মিয়ানমারের পরিস্থিতি এখনও শরণার্থীদের প্রত্যাবর্তনের জন্য অনুকূল নয়।
মিয়ানমারের সংশ্লিষ্ট এলাকার পরিস্থিতি ভালোভাবে বোঝা এবং শরণার্থী ও অভ্যন্তরীণভাবে বাস্তুচ্যুত লোকদের ফিরে যাওয়ার ব্যাপারে সুচিন্তিত সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্য দেশটিতে অবাধ প্রবেশাধিকার প্রয়োজন। বুঝেশুনে, নিরাপদে, স্বেচ্ছায় এবং মর্যাদাপূর্ণভাবে প্রত্যাবাসনের ব্যাপারে বাংলাদেশ সরকারের অব্যাহত অঙ্গীকার এবং ইউএনএইচসিআরকে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ার নেতৃত্বে রাখাকে আমরা স্বাগত জানাই।
রোহিঙ্গাদের অপরিণত প্রত্যাবাসনের বিষয়ে এক বিবৃতিতে উদ্বেগ জানিয়েছেন কানাডার পররাষ্ট্রমন্ত্রী। জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর মতামত উল্লেখ করে তিনি বলেন, রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফিরে যাওয়ার মতো সহায়ক পরিস্থিতি তৈরি হয়নি।
রোহিঙ্গা পরিস্থিতি সরেজমিন পরিদর্শনের লক্ষ্যে যুক্তরাষ্ট্রের জনসংখ্যা, শরণার্থী এবং অভিবাসী (পিআরএম) বিষয়ক উপসহকারী সেক্রেটারি রিচার্ড অলব্রাইট বাংলাদেশ সফর করেছেন। ১০ নভেম্বর তিনি বাংলাদেশে আসেন। বৃহস্পতিবার পর্যন্ত তার এ সফর ছিল। ঢাকার মার্কিন দূতাবাসের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, রোহিঙ্গা নাগরিকদের অবস্থা মূল্যায়ন করতে বাংলাদেশে অবস্থানকালে তিনি ১১ থেকে ১৩ নভেম্বর রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শন করেন। অল ব্রাইট কক্সবাজারে অবস্থানকালে তার সঙ্গে ইউএসএইড’র মিশন পরিচালক ডেরিক ব্রাউন ছিলেন। তারা কুনাপাড়া সীমান্ত এলাকা, জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশনের (ইউএনএইচসিআর) ট্রানজিট সেন্টার এবং যুক্তরাষ্ট্র সরকারসহ বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিউএফপি), ইউনিসেফ, রেডক্রস এবং আন্তর্জাতিক শরণার্থী সংস্থা পরিচালিত চিকিৎসা, খাদ্য বিতরণ, পুষ্টিসেবা কার্যক্রম পরিদর্শন করেন।
রোহিঙ্গারা না চাওয়ায় প্রত্যাবাসন স্থগিত : টেকনাফ ও উখিয়া (কক্সবাজার) প্রতিনিধি জানিয়েছেন, পরিস্থিতি অনুকূল না হওয়ায় আতঙ্কিত ও ক্ষুব্ধ রোহিঙ্গারা মিয়ানমারে ফিরতে চান না। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, বৃহস্পতিবার দুপুরে প্রত্যাবাসনের জন্য টেকনাফের উনচিপ্রাং ক্যাম্প থেকে রোহিঙ্গাদের নিয়ে আসতে শরণার্থী, ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনের (আরআরআরসি) কয়েকটি বাস গেলে বিক্ষোভ শুরু করেন রোহিঙ্গারা। সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের সামনে বাসগুলো ঘিরে ধরে মিয়ানমারে ‘ন যাইয়ুম ন যাইয়ুম’ বলে স্লোগান দেন রোহিঙ্গারা। ক্যাম্প ছেড়ে পালিয়ে যান প্রত্যাবাসনে তালিকাভুক্ত অনেকে।
এমন অবস্থায় এদিন পূর্বনির্ধারিত প্রত্যাবাসন কার্যক্রম স্থগিত করেন সংশ্লিষ্টরা।
রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন উদ্যোগ বন্ধ করা উচিত -এইচআরডব্লিউ : জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক কর্মকর্তাদের সুপারিশ অনুযায়ী শিগগিরই রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন বন্ধ করার জন্য বাংলাদেশ সরকারের পদক্ষেপ নেয়া উচিত বলে বিবৃতি দিয়েছে মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ)। সংস্থাটির শরণার্থী অধিকারবিষয়ক পরিচালক বিল ফ্রেলিক বলেছেন, রোহিঙ্গাদের তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো শুরু করলে বাংলাদেশ খুব দ্রুত আন্তর্জাতিক সমর্থন হারাবে।
সুরক্ষা নিশ্চিতে মিয়ানমারের প্রতি আহ্বান : রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের প্রয়োজনীয় সুরক্ষা নিশ্চিত করার জন্য মিয়ানমার সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে কানাডা। বৃহস্পতিবার এক যৌথ বিবৃতিতে এই আহ্বান জানান কানাডার পররাষ্ট্রমন্ত্রী ক্রিসিয়া ফ্রিল্যান্ড এবং আন্তর্জাতিক উন্নয়নবিষয়কমন্ত্রী মেরি-ক্লাউড বিবেউ। তারা জানান, এই মাসে মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন নিয়ে ‘গভীরভাবে উদ্বিগ্ন’ কানাডা।